এম এ কবীর, ঝিনাইদহ : খাদ্যভাস্যের তালিকায় মাছ একটি নিত্য খাবার যা আমিশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থান দখল করলেও বর্তমান মাছে আগের দিনের সেই স্বাদ আর নেই। মাছ চাষে ফিড খাওয়ানোর কারণে থাকছে না প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ। পোনা উৎপাদন থেকে শুরু থেকে চলছে কৃত্তিম খাবার ভাসমান, ডুবো, লেয়ার, গ্লোয়ারের পাল্লাপাল্লি। কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আঁধার। দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছে থাকে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগন্ড প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন্য ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ মানব শরীরে আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অপরিহার্য।
নদি-নালা, খাল, বিল, হাওড়-বাওড় শুকিয়ে মুক্ত জলাশয়ের মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে এবং ফসলী জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারনে মাছের জীবনচক্র হুমকীর মুখে। কৃত্রিম উপায়ে ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও এর প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জের খাল বিলে কিছু দেশীয় মাছ মিললেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
সরোজমিন ঝিনাইদহের বেশ কয়েকটি মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির চাষের মাছ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদেশী রুই, কাতলা, চিতল, কৈ,শিং, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস এবং কার্প প্রজাতির মাছের যোগানই বেশী। দেশীয় মাছ নিয়ে কয়েকজন জন বিক্রেতা বসে আছেন। তবে তারা যে দাম হাঁকছেন তা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিক্রেতাদের দাবি এসকল ছোট মাছ এখন পাওয়া যায় না। সারাদিন মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য। মাছ বিক্রেতা তৈলকূপী গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস বলেন, বাজারে দেশী মাছের চাহিদা থাকলেও পুটি,মায়া, ট্যাংরা, খলিষা, শিং, রয়না, কাকীলা, বাইম, পাকাল, গচি, গরগতে, চিংড়ী, চ্যাং, দেশী মাগুর, পাবদাসহ এ জাতিয় মিঠা পানির মাছ নেই বল্লেই চলে।
বাজারে আসা মাছক্রেতা সুরুজ মিয়া জানান, চাষের মাছে বাজার দখল করলেও ভোক্তারা বাজার করতে এসে আগে খোঁজ করেন ছোট জাতের দেশীয় মাছ। কেননা চাষের দেশী-বিদেশী মাছে প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ থাকে না। মৎস চাষি পরিতোষ মালো জানান, চাষের মাছে ফলন বেশী হলেও ব্যবসা সফল হতে পারছে না মৎস্য চাষীরা। স্থানীয় বাজারে মৎস্য ব্যাপারীদের কাছে পাইকারি মূল্যে অল্প টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে এসব মাছ। অপরদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাছের খাদ্যের দাম। উৎপাদন খরচের সাথে চাষের মাছের বাজার মূল্য কম হওয়ায় মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মাছ চাষিরা।
ভূক্তভোগীরা জানান দেশি মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আগে প্রাকৃতিক জলাশয়, মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য পরিবেশবান্ধবনীতি ও অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ১২টি প্রজাতি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি প্রজাতি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ মিঠাপানির ২৯৬ টি প্রজাতির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয় ও মুক্ত জলাশয় রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করেছে।
মাছের জাটকা সংরক্ষণে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনও সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। দেশিয় মাছ অবশ্যই সংরক্ষণকরে মুক্ত জলাশয়ে তার অবাধ বিচরনের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ণ ও আমিশের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন।
এ বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, দেশিয় মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশি মাছ চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
যদিও বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজননক্ষেত্র, চলাচল অনেকখানি হুমকির মুখে। অনেকে না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করেন। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না।
একটা সময় গ্রামঞ্চালে বর্ষা মওসুমে দেশীয় মাছ ধরার উৎসব ছিল। বর্ষার নতুন পানিতে পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। চৈত্র, বৈশাখ এবং আষাঢ় মাসে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের ডিম, রেনু ও পোনা দিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরাতন জলাশয়গুলো সংস্কার করা, ছোট দেশি জাতের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করে মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী করে দেশীয় মাছের সংরক্ষণ করা অতিব প্রয়োজন। জলাশয়, খাল, পুকুর ভরাটের কারণে মাছের আবাসস্থল থাকছে না যার কারনে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সু-স্বাদু মাছ।
Leave a Reply